অন্যভাবে বলা যায়, দীর্ঘকালীন সময় ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশে ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে খনিজ ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ যে পাতলা আবরণী স্তর সৃষ্টি হয়, যা উদ্ভিদ বৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক তাকে মাটি বা মৃত্তিকা বলে।
মৃত্তিকা সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক বা উপাদানঃ-
1851 সালে বিশিষ্ট রুশ মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ভি ভি ডকুচেভ (V. V. Dokuchaiev) মৃত্তিকা গঠনের নিয়ন্ত্রক সমূহকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন এবং একটি সমীকরণে তা প্রকাশ করেন।
S = f (cl, o, p, t) এখানে, s=soil, f=factor, cl=climate, o=organism বা organic matter, p=parent rock, t=time
পরবর্তীকালে, 1858 সালে মৃত্তিকা বিজ্ঞানী জেনি (Jenny) এই সমীকরণের পরিবর্তন করেন। তাঁর প্রদত্ত সমীকরণটি হল-- S = f (cl, o, p, r, t)
এখানে তিনি আর একটি উপাদান সংযোজন করেছেন।
যেখানে, cl= climate (জলবায়ু), o= organism (জীবজগৎ), p= parent rock/parent materials (আদিশিলা বা জনক শিলা), r= relief (ভূপ্রকৃতি), t= time (সময়)
মৃত্তিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে জলবায়ু, জীবজগৎ- এই দুটি উপাদানের ভূমিকা সর্বাত্মক অর্থাৎ এই দুটি সক্রিয় উপাদান। এবং আদিশিলা, ভূপ্রকৃতি ও সময় মৃত্তিকা গঠনের ক্ষেত্রে পরোক্ষ প্রভাব রাখে, অর্থাৎ এই তিনটি নিষ্ক্রিয় উপাদান।
☆ জলবায়ু ➡
মৃত্তিকা সৃষ্টির সবচেয়ে প্রধান উপাদান হল জলবায়ু। জলবায়ুগত কিছু বৈশিষ্ট্য মৃত্তিকা সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাত- জলবায়ুর এই দুটি উপাদান প্রত্যক্ষভাবে মৃত্তিকা সৃষ্টিতে অংশগ্রহণ করে।
উষ্ণতা:-
◆ অধিক উষ্ণতা যুক্ত অঞ্চলে মাটিতে জৈবপদার্থ ও নাইট্রোজেনের পরিমাণ হ্রাস পায়।
◆ তাপমাত্রা বেশি হলে মাটিতে কর্দম জাতীয় খনিজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
◆ অধিক তাপমাত্রার কারণে মরু ও মরুপ্রায় অঞ্চলের মাটি শুষ্ক ও লবণাক্ত প্রকৃতির হয়।
বৃষ্টিপাত:-
◆ বৃষ্টিপাত অধিক হলে PH -এর মান হ্রাস পায় এবং মাটি আম্লিক প্রকৃতির হয়।
◆ অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে উদ্ভিদের প্রাচুর্যের কারণে অধিক জৈবপদার্থের সঞ্চয়ের ফলে মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়ে।
◆ অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট মাটির গভীরে অধঃক্ষিপ্ত হয়।
◆ আর্দ্র অঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে মৃত্তিকায় কর্দমকণার পরিমাণ বেশি হয়।
☆ জীবজগৎ ➡
জীবজগৎ মৃত্তিকা সৃষ্টির অন্যতম সক্রিয় নিয়ন্ত্রক বা সক্রিয় উপাদান। মৃত্তিকা সৃষ্টিতে এই জীবজগৎ বলতে উদ্ভিদ, প্রাণী ও জীবাণু বা অনুজীবের কথা বলা হয়েছে।
উদ্ভিদ ও প্রাণী:-
◆ উদ্ভিদের শেকড় শিলায় প্রবেশ করে এবং জল ও বায়ু চলাচলে সহায়তা করে।
◆ উদ্ভিদের পাতা, ফুল, ফল ইত্যাদি পচে গিয়ে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
◆ কেঁচো, উই, পিঁপড়ে, ইঁদুর প্রভৃতি প্রাণী মাটিতে গর্ত করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
◆ প্রাণী ও উদ্ভিদের মৃত দেহাবশেষ বিয়োজিত হয়ে মাটিতে হিউমাস রুপে সংযোজিত হয়; ফলে মাটি পুষ্টিগুণসম্পন্ন হয় ও উর্বরতা বাড়ে।
এবং, মাটিতে হিউমাসের পরিমাণ বাড়লে মাটির জলধারণ ক্ষমতা বাড়ে।
জীবাণু:-
মাটির উৎপত্তি এবং মাটিকে বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক চরিত্র প্রদানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবাণু বা অনুজীবের অবদান যথেষ্ট থাকে।
◆ জীবাণু বা অতি ক্ষুদ্র জীবগোষ্ঠী উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষকে বিয়োজিত করে মাটিতে হিউমাস সমৃদ্ধকরণে সহায়তা করে।
◆ উদ্ভিদ দেহাবশেষ জীবাণুর দ্বারা বিয়োজিত হয়ে খনিজের সৃষ্টি করে এবং তা মাটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারন করে।
☆ আদিশিলা বা জনক শিলা ➡
আদিশিলা বা জনক শিলা মৃত্তিকা সৃষ্টির অন্যতম নিয়ন্ত্রক। আদিশিলার ভৌত-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য মৃত্তিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে।
◆ মৃত্তিকার গঠন, গ্রথন ও জলধারণ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয় মৃত্তিকার মূল উপাদানের দ্বারা। তাই বিভিন্ন শিলা থেকে বিভিন্ন ধরনের মাটি গঠিত হতে দেখা যায়।
◆ আদিশিলা ফেল্ডসপার খনিজ দ্বারা গঠিত হলে কাদামাটির সৃষ্টি হয়।
◆ আদিশিলায় চুনের পরিমাণ বেশি থাকলে মাটি শক্ত গঠনের হয়।
◆ আম্লিক প্রকৃতির শিলা থেকে সৃষ্ট মৃত্তিকা সূক্ষ্ম গ্রথনযুক্ত হয় এবং ক্ষারীয় প্রকৃতির শিলা থেকে সৃষ্ট মৃত্তিকা স্থূল গ্রথনযুক্ত হয়।
◆ এছাড়া, মৃত্তিকার রং বা বর্ণ নির্ধারণে আদিশিলা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
☆ ভূপ্রকৃতি ➡
ভূ-প্রকৃতি মৃত্তিকা সৃষ্টির একটি নিষ্ক্রিয় উপাদান। ভূমির ঢাল, উচ্চতা, ঢালের অভিমুখ, ঢালের প্রকৃতি প্রভৃতি ভূ-প্রকৃতিগত বিষয় মাটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
◆ পার্বত্য ভূপ্রকৃতিতে ভূমির ঢাল বেশি হওয়ায় ক্ষয়জাত পদার্থ সহজেই অপসারিত হয় বলে মৃত্তিকার স্তর গঠন বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে মৃত্তিকা অপরিণত বা নবীন অবস্থায় থাকে।
◆ পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন উচ্চতায় ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্য বিরাজ করায় চরিত্রগত দিক থেকে আলাদা আলাদা মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়।
◆ ভূমির উত্তল ঢালে ক্ষয় ও অবতল ঢালে সঞ্চয় হওয়ার ফলে উত্তল ঢালে 'A' স্তরের পুরুত্ব হ্রাস পায় ও অবতল ঢালে 'A' স্তরের পুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।
☆ সময় ➡
মৃত্তিকা গঠনে সময় প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার না করলেও এর ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। মৃত্তিকা সৃষ্টি একটি দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া। একটি সম্পূর্ণ মৃত্তিকা পরিলেখ সৃষ্টি হতে কয়েক হাজার বছর সময় লেগে যেতে পারে।
আবহবিকারগ্রস্ত শিলা সম্পূর্ণ পরিণত মৃত্তিকায় পরিণত হতে দীর্ঘ সময় লাগে। সাধারণত 2 সেমির অধিক মৃত্তিকাস্তর সৃষ্টি হতে কয়েকশো বছর সময় লেগে যায়। মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ে অপরিণত মৃত্তিকায় স্তরায়ন সুস্পষ্ট হয় না। কয়েকশো বছর ধরে মাটি সৃষ্টির প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে তা পরিণত অবস্থায় আসে এবং এই পরিণত মৃত্তিকায় স্তরগুলি সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়।