নদীর সঞ্চয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরুপঃ
ভূমির ঢাল কমে গেলে নদীর বহন ক্ষমতা হ্রাস পায় বলে বাহিত সব পদার্থগুলি নদী আর বহন করতে পারে না। এইসময় নদীবাহিত পলি, বালি, নুড়ি, কাদা প্রভৃতি নদীর তলদেশে ও পার্শ্বদেশে জমা হতে থাকে, একেই নদীর সঞ্চয় কাজ বলে। আর এই সঞ্চয়কার্যের ফলে বিভিন্ন প্রকার ভূমিরুপ গঠিত হয়।
নদীর সঞ্চয়কার্যে সৃষ্ট ভূমিরুপসমূহঃ-
১। পললশঙ্কু ও পললব্যাজনীঃ
![]() |
পললশঙ্কু ও পললব্যাজনীঃ |
পার্বত্য অঞ্চল থেকে নদী যখন সমভূমিতে পতিত হয় ভূমির ঢাল তখন হঠাৎ কমে যায় বলে নদীর স্রোত ও বহন ক্ষমতা হ্রাস পায়।ফলে নদীবাহিত পলি, বালি, নুড়ি, কাঁকর, বড় পাথরখন্ড প্রভৃতি সমভূমিতে প্রবেশের মুখে সঞ্চিত হয়ে যে ত্রিকোণাকার বা শঙ্কু আকৃতির পললভূমির সৃষ্টি হয়, তাকে পললশঙ্কু বলে।
অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম প্রকৃতির নুড়ি, বালুকা কণা, পলি প্রভৃতি পর্বতের পাদদেশে সমভূমিতে প্রবেশের মুখে সঞ্চিত হয়ে যে অর্ধবৃত্তাকার বা হাতপাখা সদৃশ পললভূমির সৃষ্টি হয় তাকে পললব্যাজনী বলে।
উদাঃ- হিমালয়ের পাদদেশে গঙ্গার বিভিন্ন উপনদীর গতিপথে পললব্যাজনী দেখা যায়। কোশি নদীর প্রবাহপথে পললশঙ্কু এবং ঘর্ঘরা, গন্ডক নদীর প্রবাহপথে এরুপ পললব্যাজনী গঠিত হয়েছে।
২। প্লাবনভূমিঃ
সমভূমি অঞ্চলে ভূমির ঢাল কম থাকে বলে নদীবাহিত পদার্থসমূহ নদীগর্ভে কিছু পরিমাণ সঞ্চিত হয় এবং নদীখাতের গভীরতা হ্রাস পায়।এই সময় অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে নদীতে জলের পরিমাণ বেড়ে গেলে অতিরিক্ত জল নদীখাত ছাপিয়ে পার্শ্ববর্তী দু'কূল অঞ্চলকে প্লাবিত করে।এবং জলের সাথে বাহিত পলি, বালি, কাদা পার্শ্ববর্তী এলাকায় সঞ্চিত হয়ে যে বিস্তৃত এক নতুন সমতলভূমির সৃষ্টি করে, তাকে প্লাবনভূমি বলে।
উদাঃ- অসম সমভূমিতে ব্রহ্মপুত্র নদের দুপাশে প্লাবনভূমি দেখা যায়।
৩। স্বাভাবিক বাঁধঃ
![]() |
স্বাভাবিক বাঁধঃ |
নদীর জলের সঙ্গে বাহিত পলি, বালি, কাদা প্রভৃতি প্রবাহপথের মাঝে মাঝে নদীর উভয় তীর বরাবর সঞ্চিত হয়ে যে উঁচু বাঁধের মতো ভূমিরুপ সৃষ্টি করে, তাকে স্বাভাবিক বাঁধ বলে।
উদাঃ মিশরে নীলনদের দুই তীরে উঁচু স্বাভাবিক বাঁধ দেখা যায়।
বিহারে মুঙ্গের ও বক্সার অঞ্চলে গঙ্গার তীর বরাবর স্বাভাবিক বাঁধ দেখা যায়।
৪। নদীচর ও নদী-দ্বীপঃ
![]() |
নদীচর ও নদী-দ্বীপঃ |
নদীর মধ্য ও নিম্নপ্রবাহে গতিবেগ কম থাকার জন্য বহন ক্ষমতা হ্রাস পায় বলে নদীবাহিত পদার্থসমূহ নদীবক্ষে সঞ্চিত হয়ে যে চর বা চড়া-এর সৃষ্টি হয়, তাকে নদীচর বলে।
বারংবার পলি সঞ্চয়ের ফলে চর বা চড়াগুলি উঁচু হয়ে দ্বীপে পরিনত হলে সেগুলিকে নদী-দ্বীপ বলে।
উদাঃ- হুগলী নদীর ওপর সৃষ্ট নয়াচর দ্বীপটি নিম্নপ্রবাহে সৃষ্ট নদী-দ্বীপের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরন।
৫। নদীবাঁকঃ
সমভূমি অঞ্চলে নদীর গতিবেগ কমে যায় বলে সামান্য বাধার সম্মুখীন হলেই বাধা এড়ানোর জন্য নদী আঁকাবাঁকা পথে প্রবাহিত হয়। নদীর এরুপ আঁকাবাঁকা প্রবাহকে নদীবাঁক বা মিয়েন্ডার বলে।
উদাঃ- গঙ্গার মধ্য ও নিম্নগতিতে প্রবাহপথে অসংখ্য নদীবাঁকের সৃষ্টি হয়েছে।
৬। অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদঃ
![]() |
অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদঃ |
সমভূমি প্রবাহে নদীর গতিবেগ খুব কম থাকে বলে সামান্য বাধা পেলেই নদী এঁকে বেঁকে প্রবাহিত হয়। নদী যখন এঁকে বেঁকে প্রবাহিত হয় তখন প্রবাহপথের অন্তঃবাঁকের তুলনায় বহিঃবাঁকে গতিবেগ বেশি থাকায় বহিঃবাঁকে ক্ষয়কার্য চলে ও অন্তঃবাঁকে পলি,বালি সঞ্চিত হয়। নদী খুব বেশি এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হলে দুইবাঁকের মধ্যবর্তী ভূমি একসময় সম্পূর্ণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং এর ফলে নদীর দুই বাঁকের জলধারার সংযুক্তি ঘটে এবং নদী তখন বাঁকা পথ ছেড়ে সোজা পথে প্রবাহিত হয় এবং পরিত্যক্ত বাঁকটি হ্রদে পরিনত হয়। এই প্রকার হ্রদ দেখতে ঘোড়ার ক্ষুরের মতো হয় বলে, একে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ বলে।
উদাঃ- পশ্চিম টেনিসিতে মিসিসিপি নদী দ্বারা সৃষ্ট রিলফুট হ্রদ হল একটি অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ।
৭। ব-দ্বীপঃ
![]() |
ব-দ্বীপঃ |
নদী যখন মোহনার কাছে চলে আসে তখন নদীটির গতিবেগ একেবারে কমে যায়। ফলে নদীর জলের সঙ্গে বাহিত পলি, বালি প্রভৃতি মোহনার কাছে সমুদ্রের লবণাক্ত জলের সংস্পর্শে এসে সহজে জোটবদ্ধ হয় এবং মোহনা অঞ্চলে সঞ্চিত হয়। এইভাবে ক্রমাগত সঞ্চিত হতে হতে একটি মাত্রাহীন বাংলা ব অক্ষরের মতো দ্বীপের সৃষ্টি হলে, তাকে ব-দ্বীপ বলে।
উদাঃ- গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীর মোহনায় এরুপ ব-দ্বীপ সৃষ্টি হয়েছে, যা পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ।
এছাড়া,নীলনদের মোহনায় ব-দ্বীপ দেখা যায়।