মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে ঢাল বরাবর নেমে আসা সুবিশাল কঠিন চলমান বরফের স্তুপকে হিমবাহ বলে।
এককথায়, হিমবাহ হল বরফের নদী।
হিমবাহের গতিবেগ অত্যন্ত ধীর। এর গতিবেগ নির্ভর করে হিমবাহের গভীরতা ও ভূমির ঢালের ওপর।
চিরতুষারাবৃত অঞ্চলে ক্রমাগত হারে সঞ্চিত তুষার প্রবল চাপে একসময় বিশালাকার কঠিন বরফস্তুপে পরিনত হলে ঢাল বেয়ে নেমে আসে এবং হিমবাহের উৎপত্তি ঘটায়।
হিমবাহের প্রকারভেদ :
অবস্থান অনুযায়ী হিমবাহ মূলত তিনধরনের হয়,
যথা- ১। পার্বত্য বা উপত্যকা হিমবাহ: পার্বত্য উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হিমবাহ পার্বত্য বা উপত্যকা হিমবাহ নামে পরিচিত।
উদা: আলাস্কার হুবার্ড পৃথিবীর বৃহত্তম পার্বত্য হিমবাহ।
২। পাদদেশীয় হিমবাহ: পার্বত্য হিমবাহ পর্তের পাদদেশে নেমে এসে না গলে অবস্থান করলে, তা পাদদেশীয় হিমবাহ নামে পরিচিত।
উদা: আলাস্কার মালাসপিনা একটি পাদদেশীয় হিমবাহ।
৩। মহাদেশীয় হিমবাহ: মহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত সুবিশাল ও গভীর বরফের আচ্ছাদন মহাদেশীয় হিমবাহ নামে পরিচিত।
উদা: আন্টার্কটিকার ল্যামবার্ট একটি মহাদেশীয় হিমবাহ।
হিমরেখা (Snow Line):-
মেরু অঞ্চল ও উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে অত্যধিক শীতলতার জন্য যে কাল্পনিক সীমারেখার ওপরে জল জমে বরফে পরিনত হয় এবং যে সীমারেখার নীচে তুষার গলে জলে পরিনত হয়, সেই সীমারেখা কে হিমরেখা বলে।
পৃথিবীর সকল স্থানে হিমরেখা একই উচ্চতায় অবস্থান করে না।
হিমরেখার উচ্চতা বা অবস্থান যে বিষয়গুলির ওপর নির্ভর করে, তা হল-- ১। অক্ষাংশ ২। উষ্ণতা ৩। ভূমির ঢাল ৪।ঋতু পরিবর্তন প্রভৃতি।
হিমশৈল (Ice berg):- 'Iceberg' একটি জার্মান শব্দ, যার অর্থ 'বরফের পাহাড়'।
এককথায়, সমুদ্রের জলে ভাসমান বিশালাকার বরফের চাঁই বা স্তুপ কে হিমশৈল বলে।
প্রকৃতপক্ষে, হিমশৈল হল মহাদেশীয় হিমবাহের খন্ডিত অংশ।
মহাদেশীয় হিমবাহের অংশ ভেঙে গিয়ে সংলগ্ন সমুদ্রে পতিত হলে তা সমুদ্রে হিমশৈল রুপে ভেসে বেড়ায়।
হিমশৈলের ১/৯ অংশ জলের উপরে ভাসমান অবস্থায় থাকে ও ৮/৯ অংশ জলের মধ্যে নিমজ্জিত অবস্থায় অবস্থান করে।
হিমমুকুট (Ice Cap):- পর্বতশীর্ষে যে অপেক্ষাকৃত হালকা হিম আবরন টুপির মতো বেষ্টন করে থাকে, তাকে Ice Cap বা হিমমুকুট বলে।
Ice Cap হল এককথায় বরফের টুপি।
এর বিস্তৃতি অনেক কম এবং আয়তন স্বল্প।
হিম আস্তরণ বা বরফ আস্তরণ (Ice Sheet):-
এককথায় মহাদেশীয় হিমবাহের আর এক নাম বরফ আস্তরণ বা Ice Sheet.
মেরু অঞ্চলে মহাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে যে বরফের স্তুপ আস্তরণের মতো আবৃত করে রেখেছে, তাকে বরফ আস্তরণ বলে।
উদা: উত্তর মেরু প্রদেশের গ্রিনল্যান্ড ও দক্ষিণ মেরু প্রদেশের অন্তর্গত আন্টার্কটিকাকে আবৃত করে রেখেছে এইপ্রকার বরফ আস্তরণ বা বরফ ক্ষেত্র।
আইস শেলফ্ (Ice Shelf):-
যে পুরু বরফের আস্তরণের একদিক ভূমিভাগের সাথে সংযুক্ত এবং বাকি অংশ সমুদ্রে ভাসমান থাকে, সেই বরফের আস্তরণকে Ice Shelf বলে।
উদা: আন্টার্কটিকার রস আইস শেলফ্ ও রনি আইস শেলফ্।
ক্রেভাস (Crevasse):-
হিমবাহের উপরের পৃষ্ঠে যে চিড় বা ফাটল দেখা যায়, তাকে ক্রেভাস বলে।
হিমবাহ নীচের দিকে নামার সময় হঠাৎ ঢাল বৃদ্ধির কারনে হিমবাহের পৃষ্ঠভাগে যে টান পড়ে তার ফলে ক্রেভাস-এর সৃষ্টি হয়।
বার্গস্রুন্ড (Bergshrund):-
পার্বত্য অঞ্চলে পর্বতগাত্র ও হিমবাহের মধ্যে যে সংকীর্ণ গভীর ফাঁকের সৃষ্টি হয়, তাকে বার্গস্রুন্ড বলে।
এই ফাঁক বা ফাটল হিমবাহের পৃষ্ঠদেশ থেকে তলদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে।
পর্বতের উপরিভাগ থেকে উপত্যকার মধ্য দিয়ে হিমবাহ নামার সময় পর্বতগাত্রে জমে থাকা বরফস্তুপ এবং নামতে থাকা হিমবাহের মধ্যে এই ফাঁক বা ফাটলের সৃষ্টি হয়।
নুনাটাকস (Nunataks):-
এস্কিমো ভাষার শব্দ 'নুনাটাকস', যার অর্থ 'তুষারমুক্ত ভূমি'।
মহাদেশীয় হিমবাহ অধ্যুষিত অঞ্চলে বরফমুক্ত পর্বতের চূড়া বা শিখরদেশ কে নুনাটাকস বলে।
উদা: আন্টার্কটিকার 'মাউন্ট তাকাহি' একটি নুনাটাকস এর উল্লেখযোগ্য উদাহরন। এছাড়া, আন্টার্কটিকার স্থানে স্থানে অসংখ্য নুনাটাকস দেখা যায়।
বরফ স্তম্ভ (Ice Pillars):-
চারদিকে ফাটল বেষ্টিত উল্লম্ব বরফের চাঁই বা স্তুপকে
বরফ স্তম্ভ বলে।
বন্ধুর পর্বতের গা বেয়ে হিমবাহ নিচের দিকে নামার সময় ভূমির ঢাল খুব বেশি বেড়ে গেলে অসংখ্য তির্যক ও উল্লম্ব ক্রেভাস বা ফাটলগুলি বিভিন্ন দিক থেকে পরস্পরকে ছেদ করে।এর ফলে ফাটলবেষ্টিত মধ্যভাগে এইপ্রকার উল্লম্ব বরফ স্তম্ভ গঠিত হয়।